সংবাদ বিভাগ: এক ঝলকে- নাহিদ হোসেনে’র “কাঁটাতারের ডায়েরি” যে বই দৃষ্টি কেড়েছে বইপ্রেমী ও নেটিজেনদের- এ যেন বর্ডারের আত্মকথন। “কাঁটাতারের ডায়েরি”
আড়াই মিনিটের বাইরে
টেলিভিশনের পর্দায় যা দেখা যায়, তা যেন এক ঝলকের আলোকচ্ছটা। আড়াই মিনিটের একটি রিপোর্ট। দর্শক
দেখেন এবং মুহূর্তেই চলে যান অন্য চ্যানেলে, অন্য খবরের দিকে কিন্তু সেই আড়াই মিনিটের পেছনে যে কত দিনের
পরিশ্রম, কত রাতের নিদ্রাহীনতা, কত চুলচেরা বিশ্লেষণ, কত ভাঙা-গড়ার গল্প লুকিয়ে থাকে, তা শুধু জানেন সেই
রিপোর্টার । যিনি এটি তৈরি করেছেন। সেই আড়াই মিনিট যেন একটি বরফখণ্ডের চূড়া–যার নীচে লুকিয়ে থাকে এক
বিশাল সমুদ্র । সেই সমুদ্রের গল্পই আমি বলতে চাই।
শুধু ক্যামেরার সামনে দাঁড়িয়ে যাওয়া নয়। তথ্য সংগ্রহ, সূত্র যাচাই, প্রতিটি শব্দ-বাক্যের পেছনে থাকে দায়িত্ব। একটি
রিপোর্ট কখনও দলিল, কখনও প্রতিবাদ, কখনও মানবিক গল্প। আর তার আষ্টেপৃষ্ঠে থাকে প্রতিশ্রুতি।
ছোট্ট এই ক্যারিয়ারে কয়েকটি রিপোর্ট করার সৌভাগ্য হয়েছে। যার অধিকাংশ সীমান্তকেন্দ্রিক। যেসবের পেছনে জমা
হয়ে আছে অসংখ্য গল্প যা বলা হয়নি রিপোর্টে। এই বইটিতে আমি চেষ্টা করেছি সেই আড়াই মিনিটের বাইরের
গল্পগুলো তুলে ধরতে | পাঠকদের জানাতে চেয়েছি, কীভাবে একটি রিপোর্ট তৈরি হয়, কীভাবে সাংবাদিকতার পেছনে
থাকা অসংখ্য মানুষের শ্রম একটি সংবাদের রূপ দেয়।
এই বই শুধু সাংবাদিকতার গল্প নয়, এটি মানুষের গল্প। যারা খবর দেখেন, তারা হয়তো জানেন না-কত মানুষের
অজস্র পরিশ্রমের ফসল এই সংবাদ সেই শ্রমের কথা, সেই যন্ত্রণার কথা, সেই গৌরবের কিছুটা জানাতেই এই
প্রয়াস। আশা করি এই যাত্রায় আপনারা আমার সঙ্গী হবেন, কাঁটাতারের ডায়েরিতে |
সারাংশ
সূচি অনুযায়ী
১. ছিটমহলের কান্না
এই পর্বে উঠে এসেছে ছিটমহল উপ্যাখ্যান। কিভাবে ছিটমহলের উৎপত্তি সেই ইতিহাস যেমন সংক্ষেপে আছে। ৬৮
বছরের বঞ্চনা ঘুঁচিয়ে ছিটমহলের বাসিন্দাদের মুক্তি পাওয়ার গল্প আছে। চারবারের ছিটমহলের যাত্রায় আমি দেখেছি
কি মানবেতর জীবন-যাপন করতেন তারা যারা ভিন্ন পথে কাগজ তৈরি তকরেত পেরেছিলেন তারা ছাড়া বাকিরা
ছিলেন দুর্দশায়। বাংলাদেশের মাঝে বাস করেও ভারতীয় হওয়ার যন্ত্রণা। সরকারি সুযোগ সুবিধা থেকে বঞ্চিত হওয়া।
২০১৫ সালে ছিটমহল বিনিময়ের পর সেই দুঃখমোচনের গল্পের কথাও লিখেছি। কি কি বাস্তবতায় প্রায় এক হাজার
ছিটমহলের বাসিস্তা ভারত চলে গেছেন, তাদের দুঃখ আর অভিমানের গল্প আছে। আর ৩৬হাজার নতুন বাংলাদেশির
আনন্দের গল্প আছে।
২. পিলারে পাকিস্তান
স্বাধীনতার ৪৫ বছর পরও সীমানা পিলারে লেখা ছিলো পাকিস্তানের নাম। সেদিকে নজর ছিলো না সরকারের ৷ ২০১৬
সালে আমি যখন রিপোর্টটি করি তখনও দেশের চারিদিকে প্রায় ৬ হাজার পিলারে সেই নাম বয়ে বেড়াচ্ছিলো স্বাধীন
বাংলাদেশ কার্যত ভূমি জরিপ অধিদপ্তরের অবহেলাই যে এর কারণ সেই খোঁজই ছিলো রিপোর্টে শুন্য রেখায় গিয়ে
এমন পিলারের খোঁজ বের করে সেই রিপোর্ট প্রকাশের পর সরকার উদ্যোগ নেয়। দায়িত্ব নেয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী
২০২২ সালে তা শেষ হয়।
৩. টুল্যান্ডস ম্যান
যশোরের গদাধরপুরে এমন এক অদ্ভুত বাড়ি যার উঠানের মাঝখান দিয়ে গেছে র্যাডক্লিফ লাইন | বসেছে কাঁটাতার।
মালিক রেজাউল মণ্ডল দুদিকেই খাজনা দেন। তাই নিজেকে দুদেশেরই নাগরিক মানেন সীমান্তের বাস্তবতায় তার
শোয়ার ঘর বাংলাদেশে কিন্তু রান্নাঘর ভারতের অংশে ৷ এই বাড়িতে সাধারন নাগরিকরা যেতে পারেন না। কারণ
একদম শুন্য রেখায় থাকা বাড়ি। আসি যখন বাড়িটিতে যাই তখন খোদ বিজিবির সেই ব্যাটালিয়ানের কমান্ডিং
অফিসারও এটির খোঁজ জানতেন না। আমাকে নিয়েই প্রথম তিনি যান। মানচিত্রের এই অদ্ভুত খেয়াল নিয়েই টু
ল্যান্ডস ম্যান।
৪. অপারেশন রৌমারী ২৮
গরু পাচারের সচিত্র প্রতিবেদন উঠে এসেছিলো এই রিপোর্টে । ২০১৬ সালের শীতে সাত রাতের দুর্ধর্ষ অভিযান।
প্রথমে সাংবাদিক হয়েই ব্যর্থ চেষ্টার পর গরু পাচারকারী সেজে স্পাইক্যাম নিয়ে গিয়েছিলাম শুন্য রেখা পেরিয়ে
কাঁটাতারের গোড়ায় । তুলে এনেছিলাম গরু পাচারের দৃশ্য। সরকারি বাহিনীর চোখ এড়িয়ে, পাচারকারীদের ভরসা
জুগিয়ে আবার তাদের লাইনম্যানের বড় রাম দায়ের ভয় বুকে নিয়ে কয়েক রাত জোছনার আলোয় চষে বেরিয়েছিলাম
রৌমারীর সীমান্ত । শীতের রাতে থেকেছি গোয়ালঘরেও | অতঃপর স্পাইক্যামেরায় ধরা পড়েছিলো সেই পাচারের
“শৈল্পিক” দৃশ্য। প্রকাশ পেয়েছিলো একটা চক্রের ইতিবৃত্ত।
৫. বন্দরনামা
বেনাপোল বন্দর দেশের সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত স্থলবন্দর | রাজস্ব আদায়ের বিবেচনায়তো বটেই, পাসপোর্টধারী যাত্রীর
চলাচল বিবেচনায়ও এটি সর্বোচ্চ ব্যবহৃত | কিন্তু এই বন্দরে বিজিবির হয়রানিতে সাধারন যাত্রীরা বিরক্ত হয়ে
উঠেছিলো । প্রতিটি যাত্রীর প্রতিটি ব্যাগ যাচ্ছেতাইভাবে খুলে চেক করার যে অসুস্থ চর্চা, তাই ছিলো উপজীব্য
স্পাইক্যাম ব্যবহার করে তুলে এনেছিলাম সেই হয়রানির চিত্র। মানুষের কথা। ব্যবসায়ীদের ভাবনা। এমনকি বিজিবি
প্রধান রিপোর্টের ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং দেখে অন ক্যামেরা স্বীকার করেছিলেন সেই অভিযোগ । পরে স্ক্যানার বসিয়ে সমাধানও
করেছিলেন তবে বছর দুয়েক পর আবারও আগের চেহারায় ফেরে বেনাপোল |
৬. অল টেরেইন ভেহিকল
বিজিবি এটিভি নামে একটা বাহন কিনেছিলো পাহাড়-ঝর্ণার দুর্গম সীমান্তে ব্যবহারের জন্য৷ কিন্তু এগুলো ব্যবহারের
জন্য কোনো রাস্তার বন্দোবস্ত না করেই | ব্যতিক্রম ছিলো খাগড়াছড়ির পানছড়ি ব্যাটালিয়ান। সরকারি কোনো বরাদ্দ
ছাড়াই বিজিবি সদস্যদের নিজ প্রচেষ্টায় তারা তৈরি করেছিলেন ৫০ কিলোমিটারের বেশি রাস্তা। সেই নিজেদের
প্রচেষ্টায় তৈরি রাস্তা দেখতে আর এটিভির ব্যবহার দেখেছিলাম গহীন অরণ্যের সীমান্তে গিয়ে। ৭. মিশন চিম্বূলই
বিজিবির বদনাম যেমন আছে বিপরীতে বিজিবি বাহবা নেয়ার মতো কাজও আছে। ২০১৪ সাল পর্যন্ত পার্বত্য অঞ্চলের
কয়েকশ কিলোমিটার সীমান্ত ছিলো অরক্ষিত। এরপর ধাপে ধাপে সেই দুর্গম পার্বত্য অঞ্চলে বিওপি গড়ে ওঠে।
সাজেক থেকে ওপরের দিকে উঠে যেতে থাকলে মিজোরামের সীমান্ত ঘেঁষা প্রায় দেড়শ কিলোমিটার জায়গায় আছে
কয়েকটি বিওপি 1 তার মধ্যে অন্যতম দুর্গম হলো Hye | এই দেড়-দুইশ কিলোমিটারের সেনাবাহিনীও নেই । আছে
শুধু বিজিবি চিম্বূলই বিওপিতে যেতে সাত থেকে আটদিন হাঁটতে হত।