“উচ্চ আদালতের ঐতিহাসিক রায়: নিরাপদ সুপেয় পানি এখন নাগরিকের মৌলিক অধিকার”

সংবাদ বিভাগ: (ফাইজুল ইসলাম, প্রভাষক, আইন বিভাগ, প্রাইম ইউনিভার্সিটি): নিরাপদ সুপেয় পানি মানুষের বেঁচে থাকার অন্যতম মৌলিক চাহিদা। তবে এটি শুধু একটি চাহিদা নয় বরং এটি মানুষের মৌলিক অধিকার হিসেবে স্বীকৃত। সম্প্রতি বাংলাদেশ হাইকোর্ট নিরাপদ সুপেয় পানি পাওয়ার অধিকারকে মৌলিক অধিকার হিসেবে ঘোষণা করেছেন। আদালতের এই রায় দেশের প্রতিটি নাগরিকের জন্য সুপেয় পানি প্রাপ্তি নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক।

পানির হাহাকারে জনজীবন বিপর্যস্ত, অনেক জায়গায় সুপেয় পানির ব্যাবস্থা করাও এক ধরনের বিলাসিতা।জীবনধারণের জন্য পানি অপরিহার্য বস্ত হলেও বাস্তবতায় আমরা অনেকেই এটা মেনে নিতে নারাজ। আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত ১৯৯১ সালেই একটি মামলায় সুপেয় পানির অধিকারকে সাংবিধানিক স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে।

ভারতে এখন আর পানি মৌলিক নীতি না মৌলিক অধিকার। Subhash Kumar v. State of Bihar (1991) – সুপেয় পানি এবং দূষণমুক্ত পরিবেশকে মৌলিক অধিকার হিসেবে ঘোষণা করা হয়। এটি ভারতের ইতিহাসে একটি যুগান্তকারী রায় হিসেবে স্বীকৃত। আরেকটি মামলায় Narmada Bachao Andolan v. Union of India (2000) – সুপেয় পানি জনগণের মৌলিক চাহিদা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়।

সম্প্রতি বাংলাদেশের মহামান্য উচ্চ আদালত সুপেয় পানির অধিকারকে মৌলিক অধিকার হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছেন।গত ৩৭ এ ফেব্রুয়ারী বিচারপতি মো আশরাফুল কামাল ও বিচারপতি ওয়ালিউল ইসলামের সমন্বয়ে গঠিত বেঞ্চ এই রায় দেন।

এই লেখাতে আমরা হাইকোর্টের রায়ের বিশ্লেষণ, সংবিধানের সাথে এর সম্পর্ক, আইনগত দিক ও বাস্তবায়ন কৌশল সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করব। এই রায়ের একজায়গায় মহামান্য আদালত আগামী দশ বছরের মধ্যে পানির দাম সাশ্রয়ী মূল্যে গ্রাহকদের হাতে তুলে দেয়ার নির্দেশনা দেন। অনেক প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ডস অ্যান্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউশন (BSTI) থেকে অনুমোদন না নিয়ে বোতলজাত পানি উৎপাদন ও বাজারজাত করছে সাম্প্রতিক সময়ে। এসব পানি প্রয়োজনীয় পরিশোধন প্রক্রিয়া ছাড়াই বাজারে আসে, যা স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর হতে পারে।

নিরাপদ সুপেয় পানি: মৌলিক অধিকার হিসেবে স্বীকৃতি
বাংলাদেশের সংবিধানের ৩২ নম্বর অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, “প্রত্যেক নাগরিকের জীবন ও ব্যক্তিগত স্বাধীনতার অধিকার থাকবে, আইনের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত ব্যতিক্রম ব্যতীত এই অধিকার কোন অবস্থাতেই বিঘ্নিত হবে না।”

মহামান্য হাইকোর্ট এই অনুচ্ছেদের ভিত্তিতেই রায় দিয়েছেন যে, সুপেয় পানি না পাওয়ার কারণে যদি মানুষের জীবন ও স্বাস্থ্য ঝুঁকির মুখে পড়ে, তাহলে সেটি তাদের মৌলিক অধিকারের লঙ্ঘন বলে গণ্য হবে। শুধু মৌলিক অধিকার হিসেবেই বিবেচিত হবে না এটি জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশের সাথে জড়িত। সম্প্রতি মহামান্য হাইকোর্টের রায়ের মূল আলোচ্য বিষয়সমূহ

নিরাপদ সুপেয় পানি পাওয়া সকল মানুষের মৌলিক অধিকার। জনসমাগমপূর্ণ স্থানে যেমন আদালত, ধর্মীয় উপাসনালয়, হাসপাতাল, রেলস্টেশন, বাসস্ট্যান্ড, বিমানবন্দরসহ জনগুরুত্বপূর্ণ স্থানে এক বছরের মধ্যে বিনা মূল্যে সুপেয় পানি সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে।

আগামী ১০ বছরের মধ্যে দেশের প্রতিটি নাগরিককে সাশ্রয়ী মূল্যে নিরাপদ পানির ব্যবস্থা করতে হবে কোন ধরনের ভোগান্তি ছাড়া পানি দূষণ রোধ এবং পানির উৎস সংরক্ষণ নিশ্চিত করতে সরকারকে সহযোগিতা করা।

আদালতের নির্দেশনার বাস্তবায়ন অগ্রগতি প্রতিবেদন প্রতি বছর আদালতে জমা দিতে হবে। নিরাপদ পানি সর্বজনীন করার জন্য সকল প্রতিবন্ধকতার বিরুদ্ধে অবস্থান নিতে হবে।

সংবিধান ও আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী সুপেয় পানির অধিকার
বাংলাদেশ সংবিধান
বাংলাদেশ সংবিধানের ১৮(১) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, “জনস্বাস্থ্য উন্নয়নের জন্য রাষ্ট্র কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করবে।’’ এই অনুচ্ছেদের আলোকে সুপেয় পানি নিশ্চিত করাও রাষ্ট্রের দায়িত্ব। পানির চেয়ে বড় কোন উপাদান নাই যা আমাদের মানব শরীরের প্রতি সরাসরি প্রভাব পড়ে। পানির মাধ্যমেই বিভিন্ন রোগ জীবাণু ছড়িয়ে পড়ে বিগত সালগুলোতে আমার এর প্রকোপ দেখতে পেয়েছি।সংবিধানে এই রায়ের আগে পানির সুব্যবস্থাপনা মৌলিক নীতির মধ্যে অন্তর্গত ছিল বর্তমানে তা মৌলিক অধিকার।

আন্তর্জাতিক আইনের দৃষ্টিকোণ
জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ ২০১০ সালে ঘোষণা করেছে যে, “নিরাপদ পানি পাওয়া একটি মৌলিক মানবাধিকার।’’জাতিসংঘের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (SDG) ৬ অনুযায়ী, ২০৩০ সালের মধ্যে সকল নাগরিকের জন্য নিরাপদ পানি সরবরাহ নিশ্চিত করা হবে। হাইকোর্টের রায় এই আন্তর্জাতিক প্রতিশ্রুতির সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ।যেহেতু বাংলাদেশ জাতিসংঘের গুরুত্বপূর্ণ সদস্য রাষ্ট্র।তাই আন্তর্জাতিক আইনের চুক্তির সংবিধিবদ্ধ নীতি (Pacta Sant Survanda) ও আন্তর্জাতিক আইনের আরেকটা মৌলিক নীতি (Jus cogens)মেনে চলতে বাধ্য।বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম স্বাস্থ্য ঝুঁকির দেশ।আশা করি এই রায় বাংলাদেশের স্বাস্থ্য সংকপ্ট উত্তোরণে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করবে।

বিদ্যমান আইন ও আদালতের ব্যাখ্যা
বাংলাদেশে সুপেয় পানির অধিকার নিশ্চিত করতে বেশ কিছু আইন রয়েছে, যেমন:

পানি সরবরাহ ও পয়ঃনিষ্কাশন কর্তৃপক্ষ আইন, ১৯৯৬ – যা শহর এলাকায় পানি সরবরাহের দায়িত্ব সংস্থাগুলোকে দিয়েছে।বিভিন্ন বিধিবদ্ধ সংস্থা যেমন ঢাকা ওয়াসা। কিন্তু সম্প্রতিকালে এই সংস্থাগুলোর কার্যক্রম নিয়ে প্রশ্ন রয়েই গেছে।

পরিবেশ সংরক্ষণ আইন, ১৯৯৫ – যা দূষণ রোধে পদক্ষেপ গ্রহণের নির্দেশ দেয়।১৯৯৫ সালের এই আইন বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে খুব ভালো একটা আইন। কিন্ত সমসাময়িক অনেক বিষয়কে এই আইন দিয়ে ব্যখা করার সুযোগ নেই বললেই চলে।

স্থানীয় সরকার (পৌরসভা) আইন, ২০০৯ – যা পৌরসভার মাধ্যমে নিরাপদ পানি সরবরাহের বাধ্যবাধকতা সৃষ্টি করে। অনেক পৌরসভাতে উচ্চমূল্যে পানির দাম নির্ধারণে দরকষাকষি চলে যা বিভিন্ন পত্রিকায় উঠে এসেছে। তবে এসব আইন থাকা সত্ত্বেও নিরাপদ পানির প্রাপ্যতা এখনও চ্যালেঞ্জের মুখে রয়েছে, যার জন্য আদালতের নির্দেশনা বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ।

আদালতের রায়: বাংলাদেশের পানি সংকট ও আদালতের হস্তক্ষেপ
বাংলাদেশে নিরাপদ পানির অভাবের কারণে প্রতি বছর লক্ষাধিক মানুষ পানিবাহিত রোগে আক্রান্ত হয়। বিশেষত, গ্রামীণ ও বস্তি এলাকায় দূষিত পানির কারণে ডায়রিয়া, টাইফয়েড ও হেপাটাইটিসের প্রকোপ বেশি। ২০১০ সালে ঢাকা ওয়াসার পানি দূষণ নিয়ে একটি মামলা করা হয়েছিল, যেখানে আদালত নির্দেশ দেন যে ওয়াসার পানি বিশুদ্ধ করার ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।

২০২০ সালের ২৫ মার্চ হাইকোর্ট দেশের মানুষকে বিনামূল্যে সুপেয় পানি সরবরাহের নির্দেশ দেন এবং পাঁচ বছর পর সেই রুলের চূড়ান্ত রায় দেওয়া হয়। এটি বাংলাদেশের সমসাময়িক কালের ইতিহাসে একটি মাইলফলক।

নিরাপদ সুপেয় পানির অধিকার মানুষের জনজীবনের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রাভাব বিস্তার করে।অধিকার হিসাবেই বিবেচনা করলে প্রভাবশালী অধিকার।মাননীয় আদালত তার রায়ে সকল নাগরিকের জন্য: আগামী ১০ বছরের মধ্যে দেশের প্রতিটি নাগরিকের জন্য সাশ্রয়ী মূল্যে নিরাপদ ও পানযোগ্য পানি সরবরাহের ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। এটি আদালতের পক্ষ থেকে সরকারকে সরাসরি নির্দেশনা যা বর্তমানে বাংলাদেশের বিধিবদ্ধ আইন। আমি মনে করি সরকারের সামনে বড় চ্যালেঞ্জ এখন সবার জন্য নিরাপদ পানির ব্যবস্থা করা।

হাইকোর্টের রায়ের বাস্তবায়ন চ্যালেঞ্জ ও সুপারিশ
১. অবকাঠামো উন্নয়ন
দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে সুপেয় পানি সরবরাহের জন্য প্রয়োজনীয় অবকাঠামো নেই। সরকারকে নতুন পানির প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে হবে।বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংগঠন কিছু উদ্যোগ হাতে নিলেও স্বদিচ্ছার অভাবে তা বন্ধ হয়ে যায়

২. বাজেট বরাদ্দ
নিরাপদ পানির ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে বাজেট বৃদ্ধি করা জরুরি।সম্প্রতি ঢাকা পানি সরবরাহ ও পয়ঃনিষ্কাশন কর্তৃপক্ষ (ওয়াসা) ২০২০-২১ অর্থবছরে ৯১ কোটি ১০ লাখ ৪০ হাজার লিটার পানি আহরণ এবং ৬৯ কোটি ৫৬ লাখ ৩০ হাজার লিটার পানি সরবরাহ করেছে। তবে, এই সময়ে পানি অপচয়ের হার ছিল ২৩.২৯%।

৩. তদারকি ও জবাবদিহিতা
সরকারি সংস্থাগুলোর কার্যক্রম নিয়মিত পর্যবেক্ষণ করতে হবে যাতে তারা দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করে।অনেকেই দায়িত্বে অবহেলার খবর আমরা বিভিন্ন সময়ে পত্রপত্রিকায় দেখেছি।

৪. জনসচেতনতা বৃদ্ধি
পানি সংরক্ষণ, দূষণ রোধ এবং বিশুদ্ধ পানি ব্যবহারের বিষয়ে জনগণকে সচেতন করতে প্রচারণা চালাতে হবে।অনেক মানুষ এখনো নদী সমুদ্রের পানি পুকুরের পানি সরাসরি খায়।

হাইকোর্টের এই রায় বাংলাদেশের মানুষের জন্য একটি যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত। এটি শুধু আইনগত স্বীকৃতি নয় বরং জনগণের জীবনমান উন্নয়নের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ।এই রায়ে আদালত পানি দূষণ ও পানির নিরাপদ ব্যবস্থাপনা পরিকল্পনা করতে বলেছেন।

যদি এই রায় যথাযথভাবে বাস্তবায়িত হয়, তাহলে বাংলাদেশের প্রতিটি নাগরিক নিরাপদ ও সুপেয় পানির সুবিধা ভোগ করতে পারবে যা অদূর ভবিষ্যতে তাদের স্বাস্থ্য সুরক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।

এখন প্রয়োজন সরকারের দৃঢ় পরিকল্পনা ও জনগণের সচেতন অংশগ্রহণ। সুপেয় পানি পাওয়া শুধু একটি মৌলিক অধিকার নয় এটি একটি সামাজিক দায়িত্বও। রাষ্ট্র ও জনগণ একসাথে কাজ করলে এই অধিকার বাস্তবে পরিণত করা সম্ভব!

  • Related Posts

    “আমাদের ওপর আক্রমণ করবেন না: আইজিপি”

    সংবাদ বিভাগ: পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) বাহারুল আলম বলেছেন, আমাদের কাজ করতে দেন। অনুগ্রহ করে আমাদের ওপর আক্রমণ করবেন না। বৃহস্পতিবার (১৩ মার্চ) সকাল ১০টায় গাজীপুরের ভোগড়া বাইপাস এলাকায় শিল্পপুলিশ-২ এর…

    “জানাজানি হওয়ায় ঘুষের টাকা ফেরত দিলেন এসআই”

    সংবাদ বিভাগ: ময়মনসিংহের ঈশ্বরগঞ্জের জাটিয়া উচ্চ বিদ‍্যালয়ের নৈশপ্রহরী মো. আরমান হোসেন (২৪) হত্যা মামলায় পুলিশের বিরুদ্ধে ঘুষ বাণিজ্য নিয়ে সংবাদ প্রকাশের পর টাকা ফেরত দিয়েছেন। ছবি: এসআই নজরুল ইসলাম। বুধবার…

    Leave a Reply

    Your email address will not be published. Required fields are marked *