“রাজনীতি’র নয়া বাতাস”

সংবাদ বিভাগ: জুলাই গণঅভ্যুত্থান-পরবর্তী সময়ে দীর্ঘদিনের মিত্র বিএনপির সঙ্গে সম্পর্কে ফাটল দেখা দেয় জামায়াতে ইসলামীর। দুই দলেরই অবস্থা হয়ে ওঠে বিপরীতমুখী। সভা-সমাবেশে একদলের নেতারা অন্য দলের নেতাদের বিরুদ্ধে কথা বলতেও ছাড় দেননি। আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়েও দল দুটির অবস্থান ছিল বিপরীতমুখী। বিএনপি ডিসেম্বরে নির্বাচনের দাবি জানালেও জামায়াত বলেছে, সংস্কারের আগে তারা কোনো নির্বাচন চান না। তবে সম্প্রতি লন্ডনে বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া ও ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাতের পর জামায়াতে ইসলামীর সুর কিছু পাল্টেছে।

এবার দলটির আমির ডা. শফিকুর রহমান বলছেন, তারাও আগামী রমজানের আগে ভোট চান। রমজান হলে আগামী বছরের মধ্য ফেব্রুয়ারিতে- অর্থাৎ এর আগেই ভোট চান তারা। এ ছাড়া তিনি বিএনপির সঙ্গে ফের জোট বাঁধার ইঙ্গিত দিয়েছেন। জামায়াত ছাড়াও খেলাফত মজলিস, ইসলামী আন্দোলন, হেফাজতে ইসলাম, নাগরিক ঐক্য, গণ অধিকার পরিষদ, সিপিবি-বাসদসহ অন্যান্য বাম দল এবং বিএনপির মিত্র দলগুলোও চলতি বছরের মধ্যে ভোট চায়। তবে সংস্কার শেষে ভোটের দাবি করেছে ছাত্রদের নতুন রাজনৈতিক দল এনসিপি। তারা বলছে, সংস্কারের আগে ভোট হলে তারা নির্বাচনে অংশ নেবেন না। সব মিলিয়ে বিএনপির সঙ্গে সম্পর্ক ও নির্বাচন ইস্যুতে জামায়াতে ইসলামীর ইউটার্নের পর রাজনীতিতে দেখা দিয়েছে নতুন মোড়।

রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, ৫ আগস্টের পরে সংস্কার ও নির্বাচন ইস্যুতে জামায়াতের যে অবস্থান ছিল, যা বিএনপির সঙ্গে পুরোপুরি উল্টো। এখন জামায়াত নির্বাচন ও সংস্কার নিয়ে যে কথা বলছে, তা অনেকটা পরিবর্তন বলা যায়। এই পরিবর্তন হয়তো লন্ডনে খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানের সঙ্গে জামায়াতের আমিরের বৈঠকের ফল হতে পারে। বিষয়টি আরো কয়েক দিন গেলে পরিষ্কার বোঝা যাবে। যদি দুই দলের সম্পর্ক আগের মতো ঠিকঠাক হয়, তবে রাজনীতিতে নতুন সমীকরণ দেখা দেবে।

সম্প্রতি ইউরোপীয় ইউনিয়নের কয়েকটি দেশ সফর শেষে দেশে ফিরে গতকাল বৃহস্পতিবার সংবাদ সম্মেলনে বসেন জামায়াতের আমির ডা. শফিকুর রহমান। এই সংবাদ সম্মেলনে খালেদা জিয়ার সঙ্গে সাক্ষাৎ, বিএনপির সঙ্গে আগামী দিনের সম্পর্ক কী হবে তার ইঙ্গিতও দেন তিনি। এ ছাড়া খালেদা জিয়ার সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাতে রাজনীতি নিয়েও আলোচনা হয়েছে। তবে কী আলোচনা হয়েছে, তা তিনি খোলাসা করেননি।

জোটসঙ্গী বিএনপির সঙ্গে এখন নানা বিষয়ে মতপার্থক্য থাকলেও বিষয়টিকে ‘বিরোধ’ বলতে রাজি নন জামায়াতের আমির। বলেন, যদি আপনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের গত নির্বাচন দেখেন, তাহলে এটা কোনো বিরোধই নয়। সেখানে তো বাকযুদ্ধ হয়েছে অনেক। ওই নির্বাচনের পর হ্যান্ডশেক। একদল সরকারে, আরেক দল বিরোধী দলে। এখন তারা মিলেমিশে দেশ চালাবে, এটাই স্বাভাবিক।

আগামী নির্বাচনে জামায়াত আবার বিএনপির সঙ্গে জোট বাঁধবে কি না এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘দেশের প্রয়োজনে’ অনেক কিছুই হতে পারে। তিনি বলেন, দেশ ও জাতির স্বার্থ বিবেচনায় রাজনৈতিক দলগুলো কোনো উত্তম সিদ্ধান্ত যেকোনো সময় নিতেই পারে। কিন্তু ইতিমধ্যে কোনো কোনো দলের পক্ষে স্পষ্ট করে বলা হয়েছে যে, ‘আমরা কোনো রাজনৈতিক জোট করব না।’ আমরা এখানেই আপাতত থাকি; আর অপেক্ষা করতে থাকি।

বিএনপি ডিসেম্বরে নির্বাচনের দাবিতে অটল। তবে জামায়াতের আমির গত বুধবার রমজানের আগে নির্বাচনের কথা বললেও গতকাল বৃহস্পতিবার বলেছেন, আমি বলি নাই যে ফেব্রুয়ারির ভেতরে নির্বাচন হতে হবে। আমি অনেকগুলো কারণে সেখানে বলেছি যে কেন এই ফেব্রুয়ারিকে চয়েজ করা যায়। এরপর এটা কোরআনের আয়াত নয়। বাস্তবের প্রয়োজনে একটু আগাইতে পারে, একটু পিছাইতে পারে। তবে এত দিন জামায়াতে ইসলামী বলে আসছিল, সংস্কারের পর নির্বাচনের পক্ষে তারা। নির্বাচন নিয়ে দলটির মধ্যে ছিল না কোনো তাড়াহুড়োও।

নির্বাচন আগামী জুনের পর যেন না যায় সেদিকেও সকর্ত দৃষ্টি রাখবেন বলে জানিয়েছেন জামায়াত আমির। তিনি বলেন, প্রধান উপদেষ্টা বলেছেন যে ডিসেম্বর থেকে পরবর্তী বছরের জুনের মধ্যে নির্বাচন হবে। আমরা এই সময়টাকে প্রস্তুতির জন্য, সংস্কারের জন্য, বিচারের জন্য আমরা মনে করি যে এই সময়টা গ্রহণযোগ্য। কিন্তু এই সময়ের সীমা যেন অতিক্রম করে না যায়, সে ব্যাপারে আমরা সতর্ক দৃষ্টি রাখব।

এদিকে নির্বাচন দিয়ে ডান-বাম সব দলের সঙ্গেই যোগাযোগ রাখছে বিএনপি। বিভিন্ন দলের সঙ্গে পৃথক পৃথক বৈঠকও করছে দলটি। বিএনপির পাশাপাশি খেলাফত মজলিস, ইসলামী আন্দোলন, হেফাজতে ইসলাম, গণ অধিকার পরিষদ, সিপিবি-বাসদ, নাগরিক ঐক্যসহ অন্যান্য বাম দল এবং বিএনপির মিত্র দলগুলোও ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচনের বিষয়ে বিএনপির সঙ্গে একমত। তারাও বিভিন্ন সভা-সমাবেশে ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচনের দাবি তুলছেন।

এদিকে নির্বাচনকে কেন্দ্র করে মাঠে আসছে নতুন নতুন রাজনৈতিক দল। সর্বশেষ গতকাল ডেসটিনির রফিকুল আমীন আনলেন ‘আ-আম জনতা পার্টি’। এসব দলের মধ্যেও অনেকেই কথা বলছেন বিএনপির সুরে। তবে নির্বাচন নিয়ে বিএনপির সুরের উল্টো কথা বলছেন ছাত্রদের নতুন রাজনৈতিক দল জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) ও দু-একটি রাজনৈতিক দল। মৌলিক সংস্কার ছাড়া এনসিপি নির্বাচনে যাবে না বলেও ইঙ্গিত দিয়েছেন দলটির শীর্ষ নেতারা। দলটির কয়েকজন নেতাও বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে ৫ বছর ক্ষমতায় রাখার কথা বলছেন। সর্বশেষ গত বুধবার দলটির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম বলেছেন, কোনো ধরনের মৌলিক পরিবর্তন ছাড়া নির্বাচনের দিকে গেলে সে নির্বাচন গ্রহণযোগ্য হবে না এবং সে নির্বাচনে জাতীয় নাগরিক পার্টি অংশগ্রহণ করবে কি না, সেটাও বিবেচনাধীন থাকবে।

তিনি অভিযোগ করে বলেন, বর্তমান প্রশাসন বিএনপির পক্ষে কাজ করছে। মাঠ প্রশাসন নিরপেক্ষ আচরণ করছে না। তিনি বলেন, বিভিন্ন স্থানে এনসিপির নেতা-কর্মীদের ওপর হামলা করা হলেও তারা নিশ্চুপ ভূমিকা পালন করছেন। অনেক জায়গায় প্রশাসন বিএনপির পক্ষ অবলম্বন করছে এবং চাঁদাবাজির ঘটনায়ও তারা নীরব দর্শক। এ ধরনের প্রশাসনের অধীনে নির্বাচন সুষ্ঠু হতে পারে না।

বিএনপি ও জামায়াতের সম্পর্কের এই উন্নতি নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক কাজী মাহবুবুর রহমান বলেন, কারো কারো ধারণা জামায়াতে ইসলামী হয়তো ৫ আগস্টের পর নিজেদের অনেক শক্তিশালী ও জনপ্রিয় রাজনৈতিক দল হিসেবে মনে করছিল। একই সঙ্গে অনেক ভোট পেয়ে এককভাবে ক্ষমতায় যেতে পারবে- এই বিশ্বাসও হয়তো তারা করত। তবে তাদের সেই ধারণা যথার্ত ছিল কি না বা এটা অতিমূল্যায়ন ছিল কি না সেটা তারা হয়তো এখন ভাবছে। সেই জায়গা থেকে জামায়াত বিএনপির সঙ্গে জোট করতে আগ্রহ প্রকাশ করলে বিএনপি তাদের বর্তমান জনপ্রিয়তার স্থান থেকে কতটা ছাড় দিয়ে জোটবদ্ধ হতে পারবে সেটা ভাবনার বিষয়। আর জোটবদ্ধ মানেই যে নির্বাচনী জোট সেটা না-ও হতে পারে। সেটি দ্রুত নির্বাচন এবং সংস্কারপন্থি জোটও হতে পারে। তবে কোনোভাবে তারা যদি জোট হয় তবে রাজনীতিতে কোনো সংকট হবে না।
অন্যদিকে অন্তর্বর্তী সরকারের বয়স আট মাস পার হলেও নির্বাচনের সুনির্দিষ্ট রোডম্যাপ দিচ্ছে না। যদিও সরকার বলছে, তবে ডিসেম্বর থেকে জুনের মধ্যে নির্বাচন হবে। তবে সরকারে সুনির্দিষ্ট রোডম্যাপ না দেওয়ায় সরকার সম্পর্কে বিএনপিসহ অধিকাংশ রাজনৈতিক দল ও সাধারণ মানুষের মনে তৈরি হচ্ছে নানা সন্দেহ। বিএনপি ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচনের দাবিতে অনড়। যদিও নির্বাচনের তারিখ নিয়ে সরকার এবং রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে বেশি সময়ের পার্থক্য খুব একটা নেই।

নির্বাচন একটু দেরিতে হলে অসুবিধা কোথায়- এমন প্রশ্নে বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব সৈয়দ এমরান সালেহ বলেন, নির্বাচন দেরিতে হলে রাষ্ট্রের অর্গানগুলো অকার্যকর হয়ে পড়বে। একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র বিনির্মাণ আমাদের সবার আকাঙ্ক্ষা । যার জন্য গত ১৫ বছর আমরা লড়াই-সংগ্রাম করেছি। আওয়ামী লীগ নির্বাচনের নামে জনগণের সঙ্গে প্রতারণা ও প্রহসন করেছে, জনগণ ভোট দিতে পারেনি। নির্বাচন থেকে জনগণকে দূরে রাখা হয়েছে। আওয়ামী ফ্যাসিবাদের অবসানের পর জনগণের আকাক্সক্ষার প্রয়োজনেই নির্বাচন জরুরি। এ ছাড়া দেরিতে নির্বাচন হলে সমাজের বিশৃঙ্খলা আরও তীব্র হবে, জনগণ হতাশ হবে। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের আকাক্সক্ষা যে সাম্য মানবিক ও বৈষম্যহীন রাষ্ট্র তৈরি করা, সেটি সুদূরপরাহত হবে।

নির্বাচনের রোডম্যাপ নিয়ে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক মেজবাহ-উল-আজম সওদাগর বলেন, নির্বাচনের সময়সীমা নিয়ে এই মুহূর্তে সরকার, বিএনপি এবং জামায়াতে ইসলামীসহ অন্যান্য রাজনৈতিক দলের দূরত্ব একেবারেই কম। তিন থেকে ছয় মাস আগে বা পরে। এই সামান্য দূরত্ব বা মতানৈক্য ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে আলোচনা এবং জুলাই চার্টার স্বাক্ষরের মধ্য দিয়ে ঘুচে যাবে।
-সেলিম আহমেদ

  • Related Posts

    “নিষিদ্ধ ছাত্রলীগের ঝটিকা মিছিল,যা বলছে ডিএমপি”

    সংবাদ বিভাগ : রাজশাহী: রাজধানী ঢাকায় হঠাৎ হঠাৎ নিষিদ্ধ ঘোষিত সংগঠন ছাত্রলীগ ঝটিকা মিছিল নিয়ে আতঙ্কিত না হওয়ার জন্য অনুরোধ জানিয়েছে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ (ডিএমপি)। শনিবার (১৯ এপ্রিল) ডিএমপির ভেরিফায়েড…

    আদালতের মালখানা থেকে চুরি হওয়া টাকা ও স্বর্ণালংকার উদ্ধার

    সংবাদ বিভাগ: রাজশাহী: নাটোর আদালতের মালখানা থেকে চুরি হওয়া নগদ ৬১ লাখ ৫৯ হাজার ৩০০ টাকা ও ১৪ ভরি স্বর্ণালংকার এবং ৫৮ ভরি রুপা উদ্ধার করেছে পুলিশ। একই সঙ্গে ঘটনার…

    Leave a Reply

    Your email address will not be published. Required fields are marked *