“(ধানের সাথে মাছ চাষ) গুরুদাসপুর ও বড়াইগ্রামের প্রেক্ষাপটে সম্ভাবণা ও বাস্তবতা”

ভেতরের খবর নিউজ ডেস্ক: সম্প্রতি নাটোর জেলা বিএনপির অন্যতম সদস্য প্রফেসর আবু হেনা মোস্তফা কামাল তাঁর একটি ফেসবুক পোস্টে তিনি এ বিষয়ে বিস্তারিত গবেষণালব্ধ একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেন; তাঁর ফেসবুক পোস্টটি ভেতরে খবরের নজরে আসে:
(প্রফেসর আবু হেনা মোস্তফা কামাল):
বাংলাদেশের কৃষি ও মৎস্য খাতে উৎপাদন বাড়ানোর লক্ষ্যে ধান ও মাছের সমন্বিত চাষ একটি উদ্ভাবনী ধারণা হিসেবে বিবেচিত। এই পদ্ধতিতে একই জমিতে একসাথে ধান এবং মাছ উৎপাদন করে কৃষকের আয় বৃদ্ধি ও খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করার লক্ষ্য নেওয়া হয়। যদিও এই পদ্ধতির ধারণা নতুন নয়, এটি বহু আগে থেকেই চীনে কার্যকরভাবে ব্যবহার হয়ে আসছে। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে ২০০০ সালের দিকে বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের তত্ত্বাবধানে ধান-মাছ চাষ পদ্ধতি চালু হয়।

বর্তমানে দেশে প্রায় ২.৮৩ মিলিয়ন হেক্টর মৌসুমি প্লাবনভূমি রয়েছে, যা ধান-মাছ চাষের জন্য উপযোগী বলে গণ্য করা হয়। তবে বাস্তবে এই পদ্ধতির ব্যবহার এখনো সীমিত। Ahmed ও Garnett (2011) এর এক গবেষণায় দেখা যায়, ধান-মাছ চাষ পদ্ধতিতে ধান উৎপাদন ১০ শতাংশ পর্যন্ত বাড়ে এবং মাছ উৎপাদনের মাধ্যমে কৃষকের অতিরিক্ত আয় হয়। চীনের অভিজ্ঞতা অনুসারে ২০০০ সালের মধ্যেই দেশটির ধান-মাছ চাষের আওতায় আনা জমির পরিমাণ ১.৫৩ মিলিয়ন হেক্টর ছাড়িয়ে যায় (Lu & Li, 2006)। এর পেছনে রয়েছে উন্নত জলব্যবস্থাপনা, ধান রোপণের জন্য যথাযথ দূরত্ব বজায় রাখা, সার্কুলেশন সুবিধাসম্পন্ন পানির ব্যবস্থা এবং আধুনিক জৈব বালাইনাশকের ব্যবহার।

বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এই সুবিধাগুলো অধিকাংশ ক্ষেত্রেই অনুপস্থিত। বিশেষ করে গুরুদাসপুর ও বড়াইগ্রামের মতো এলাকার কৃষকদের মধ্যে এখনো এই চাষ পদ্ধতি নিয়ে সীমিত সচেতনতা ও প্রযুক্তিগত দক্ষতা রয়েছে। স্থানীয় চাষিরা অনেক সময় পর্যাপ্ত পানি ধরে রাখার সুযোগ পান না, যার ফলে মাছ চাষের জন্য উপযুক্ত পরিবেশ তৈরি করা কঠিন হয়ে পড়ে। অধিকাংশ জমিতে পানি মাত্র ১ থেকে ১.৫ ফুট গভীর হয়, যেখানে চীনে প্রায় ২ ফুটের বেশি পানি রাখা হয়। উপরন্তু, আমাদের দেশে ধানের গাছ সাধারণত ঘনবদ্ধভাবে রোপণ করা হয় (৬-৯ ইঞ্চি দূরত্বে), যা মাছ চলাচলের ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে।

চাষিরা অনেক সময় মনে করেন মাছ ধানের পোকামাকড় খেয়ে দেবে, ফলে কীটনাশকের প্রয়োজন কমবে। কিন্তু বাস্তবে দেখা গেছে, ধানের অধিকাংশ ক্ষতিকর পোকা পানির উপরিভাগে থাকে, যেখানে মাছের পক্ষে পৌঁছানো সম্ভব নয়। একইভাবে, মাছ দিয়ে জমির আগাছা নিয়ন্ত্রণের ধারণাটিও অনেক ক্ষেত্রেই অকার্যকর হয়েছে, কারণ ধানের জমিতে আগাছার পরিমাণ বেশি হয় এবং মাছের সংখ্যা তা নিয়ন্ত্রণ করার পক্ষে যথেষ্ট নয়। মাছের মলকে জৈব সার হিসেবে ব্যবহার করা গেলেও সেটি ধানের চাহিদা অনুযায়ী পর্যাপ্ত পুষ্টি সরবরাহ করতে পারে না। বাংলাদেশের বোরো ধানে TSP, DAP, MOP, সালফার ও অন্যান্য রাসায়নিক সারের নির্দিষ্ট মাত্রা প্রয়োজন হয়, যা মাছের বর্জ্য দিয়ে পূরণ করা অসম্ভব।

তাপমাত্রার পরিবর্তনের কারণে অনেক সময় জমির পানি অতিরিক্ত গরম হয়ে যায়, যা মাছের জন্য প্রাণঘাতী হয়। এছাড়াও ধান ও আগাছার কারণে জমিতে পরজীবি ও ব্যাকটেরিয়ার আধিক্য বাড়ে, যা মাছ ও ধানের স্বাস্থ্যে প্রভাব ফেলে। আরেকটি বড় চ্যালেঞ্জ হলো বাজার ব্যবস্থা। চীনে এক কেজি মাছ ৪-৫ ডলারে বিক্রি হয়, সেখানে বাংলাদেশে একই মাছ বিক্রি হয় গড়ে মাত্র ১.৫ ডলারে। এর ফলে কৃষক তাদের উৎপাদন খরচ তুলতে পারেন না। চীন যেখানে ২৪ ঘণ্টা বিদ্যুৎ সুবিধা পায়, সেখানে বাংলাদেশের গ্রামীণ এলাকাগুলোতে এখনো বিদ্যুৎ সরবরাহ অনিয়মিত।

এই পদ্ধতিতে সাফল্য পেতে হলে গুরুদাসপুর ও বড়াইগ্রামের মতো অঞ্চলে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে। কৃষকদের জন্য নিয়মিত প্রশিক্ষণ কর্মসূচি চালু করা, জমিতে উন্নত পানি সংরক্ষণ ব্যবস্থা গড়ে তোলা এবং সরকারিভাবে প্রণোদনা ও ভর্তুকির ব্যবস্থা রাখা জরুরি। সেই সঙ্গে মাছের ন্যায্য মূল্য নিশ্চিত করতে বাজার ব্যবস্থার উন্নয়ন করতে হবে। স্থানীয় চাহিদা ও জলবায়ুর সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে উপযোগী জাতের ধান ও মাছ নির্বাচন করে এই চাষ পদ্ধতি সঠিকভাবে প্রয়োগ করা গেলে এটি খাদ্য নিরাপত্তা ও কৃষকের আয় বৃদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।

  • Related Posts

    “মে মাসের শুরুতেই শেখ হাসিনার বিচার :প্রধান উপদেষ্টা”

    সংবাদ বিভাগ: রাজশাহী :জুলাই-আগস্ট গণহত্যা মামলায় ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিচার মে মাসের শুরুতেই শুরু হচ্ছে বলে জানিয়েছেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস। কাতারভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আল জাজিরার…

    “বিলুপ্তির পথে শীতল পাটি”

    ভেতরের খবর নিউজ ডেস্ক: গ্রাম বাংলার শিল্প ও ঐতিহ্যের অন্যতম নিদর্শন শীতল পাটি। আধুনিক সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে অনেক ঐতিহ্য হারিয়ে যাচ্ছে। তেমনই একটি শিল্প শীতল পাটি, সময়ের ব্যবধানে এ…

    Leave a Reply

    Your email address will not be published. Required fields are marked *