সাজাপ্রাপ্ত মানি-লন্ডারিং আসামি’র জামিন

সংবাদ বিভাগ:
দুর্নীতির-বিরুদ্ধে-সরকারের-তৎপরতার-মধ্যেই-সাজাপ্রাপ্ত-অর্থ-আত্মসাৎ এর দায়ে দণ্ডিত রাশেদুল হক চিশতী’কে জামিন দিয়েছে আদালত

মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইনের আওতায় বাবুল চিশতী ও তার ছেলে রাশেদুল হক চিশতীকে ১২ বছর করে কারাদণ্ড দেওয়া হয়। আর বাবুল চিশতীর স্ত্রী রোজী চিশতীকে দেওয়া হয় ৫ বছরের কারাদণ্ড। পাশাপাশি তৎকালীন ফারমার্স ব্যাংকের ফার্স্ট প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ মাসুদুর রহমান খানকে পাঁচ বছর কারাদণ্ড দেন আদালত।
সরকার যখন আটঘাঁট বেঁধে অর্থ পাচারের বিরুদ্ধে নেমেছে, ঠিক সে সময়ে মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইনে অর্থ আত্মসাতের মামলায় ১২ বছর সাজাপ্রাপ্ত রাশেদুল হক চিশতী জামিন পেয়েছেন।

সাবেক ফারমার্স ব্যাংকের নিরীক্ষা কমিটির তৎকালীন চেয়ারম্যান ব্যাংকখেকো হিসেবে পরিচিত মাহবুবুল হক চিশতী ওরফে বাবুল চিশতীর ছেলে হলেন রাশেদ চিশতী।

সাবেক ফারমার্স ব্যাংক (বর্তমানে পদ্মা ব্যাংক) থেকে ১৬০ কোটি টাকা আত্মসাৎ করায় ২০২৩ সালের ৩০ অক্টোবর বাবুল চিশতী, তার স্ত্রী ও ছেলেসহ চারজনকে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড দেন ঢাকার একটি আদালত। পাশাপাশি তাদের ৩১৯ কোটি ৯০ লাখ ৯৯ হাজার ২৪০ টাকা জরিমানা করেন আদালত।

মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইনের আওতায় বাবুল চিশতী ও তার ছেলে রাশেদুল হক চিশতীকে ১২ বছর করে কারাদণ্ড দেওয়া হয়। আর বাবুল চিশতীর স্ত্রী রোজী চিশতীকে দেওয়া হয় ৫ বছরের কারাদণ্ড। পাশাপাশি তৎকালীন ফারমার্স ব্যাংকের ফার্স্ট প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ মাসুদুর রহমান খানকে পাঁচ বছর কারাদণ্ড দেন আদালত।

এ ছাড়া মাহবুবুল হক, তার স্ত্রী রোজী চিশতী ও ছেলে রাশেদুল হকের নামে থাকা সব স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি রাষ্ট্রের অনুকূলে বাজেয়াপ্ত করার নির্দেশ দিয়েছিলেন আদালত।

পরবর্তী সময়ে সাজাপ্রাপ্ত আসামিরা উচ্চ আদালতে আপিল করেন। এর মধ্যে বৃহস্পতিবার সাজার অর্ধেকের বেশি সময় তিনি জেল খেটেছেন উল্লেখ করে রাশেদ চিশতী তার আইনজীবীর মাধ্যমে হাইকোর্টে জামিনের আবেদন করেন।

শুনানি শেষে বিচারপতি মোহাম্মদ আলী ও বিচারপতি এস কে তাহসিন আলীর সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ তার জামিন মঞ্জুর করেন।

এমন এক মুহূর্তে অর্থ আত্মসাতের মামলায় দণ্ডিত রাশেদ চিশতী জামিন পেলেন, যখন বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দুর্নীতি ও অর্থ পাচারের বিরুদ্ধে জোরেশোরে শুদ্ধি অভিযান চালাচ্ছে। পতিত আওয়ামী লীগ সরকারের সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মহীউদ্দীন খান আলমগীর তথা ম. খা. আলমগীরের ঘনিষ্ঠ ছিল ব্যাংকখেকো চিশতী পরিবার। অথচ আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর বর্তমান সরকারের অনুকম্পা পেতে তারা নানা ছলচাতুরির আশ্রয় নিচ্ছে বলে খবর পাওয়া গেছে।

যে মামলায় বাবুল চিশতী ও তার পরিবারের সদস্যদের সাজা হয় সেই মামলার অভিযোগে বলা হয়, ফারমার্স ব্যাংক লিমিটেডের কর্মকর্তাদের সহযোগিতায় ব্যাংকের নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে মাহবুবুল হক চিশতী গুলশান শাখায় সঞ্চয়ী হিসাব খুলে বিপুল পরিমাণ অর্থ নগদে ও পে-অর্ডারের মাধ্যমে জমা ও উত্তোলন করেন। তিনি বিভিন্ন সময়ে তার স্ত্রী, ছেলে, মেয়ে ও তাদের মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানের নামে বিভিন্ন শাখার মোট ২৫টি হিসাবে নগদ ও পে-অর্ডারের মাধ্যমে মোট ১৫৯ কোটি ৯৫ লাখ ৪৯ হাজার ৬৪২ টাকা সন্দেহজনক লেনদেন করেন।

হিসাবগুলোতে গ্রাহকদের হিসাব থেকে পাঠানো অর্থ স্থানান্তর, হস্তান্তর ও লেয়ারিংয়ের মাধ্যমে গ্রহণ করে এবং নিজেদের নামে কেনা ব্যাংকের শেয়ারের মূল্য পরিশোধের মাধ্যমে সন্দেহজনক লেনদেন করে মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইনের ৪ ধারায় শাস্তিযোগ্য অপরাধ করেন।

এ ছাড়া রাশেদ চিশতীর বিরুদ্ধে দুর্নীতি ও অর্থ কেলেঙ্কারির আরও আটটি মামলা বিচারাধীন।

এর আগে ফারমার্স ব্যাংকের বিপুল টাকা আত্মসাতের মামলায় বাবুল চিশতী ও তার পুরো পরিবার ফৌজদারি অপরাধে জড়িত বলে মন্তব্য করেছিলেন আপিল বিভাগ।

২০২১ সালের ২৭ মে বাবুল চিশতীর ছেলে রাশেদ চিশতীর জামিন শুনানির সময় এমন মন্তব্য করেন আপিল বিভাগের বিচারক।

তখন আদালত বলেন, মাহবুবুল হক চিশতী ওরফে বাবুল চিশতীই মূল অপরাধী।

মামলার নথি থেকে দেখা যায়, অপরাধ কার্যক্রমে তিনি তার পুরো পরিবারের সদস্যদের ব্যবহার করেছেন।

সাবেক ফারমার্স ব্যাংকের অডিট কমিটির চেয়ারম্যান মাহবুবুল হক ওরফে বাবুল চিশতীর ব্যাপক অনিয়ম ও লুটপাটের কারণে নতুন প্রজন্মের ওই ব্যাংকটি ধ্বংস হয়ে যায়।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তদন্ত প্রতিবেদন অনুযায়ী, তিনি নামে-বেনামে ঋণ, ব্যবস্থাপনা কমিটিকে তোয়াক্কা না করে ঋণ অনুমোদন, নামমাত্র প্রতিষ্ঠান তৈরি করে সেসব হিসাবে কোটি কোটি টাকা হস্তান্তর, ঋণ অনুমোদন হওয়ার আগেই টাকা সরবরাহ, ঋণগ্রহীতাদের কাছ থেকে বিপুল অঙ্কের কমিশন ও শেয়ারবাণিজ্য করেছেন।

শুধু তা-ই নয়, ব্যাংকটিতে নিয়োগের ক্ষেত্রেও ব্যাপক অনিয়মের প্রমাণ পাওয়া গেছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিদর্শন দলের রিপোর্ট বলছে, ২০১৭ সালে ৮৫ জন কর্মকর্তা নিয়োগে প্রায় প্রতিটির ক্ষেত্রে তখনকার চেয়ারম্যানের সুপারিশ ছিল। অনেক প্রার্থীর বায়োডাটায় ‘চেয়ারম্যান ও ডিরেক্টর চিশতী’ বড় করে লেখা ছিল বলে বাংলাদেশ ব্যাংকের পর্যবেক্ষকদের নজরে আসে।

এইচআর কর্তৃক লিখিত পরীক্ষা নেওয়া হয়েছে। তবে তা শুধুই নামমাত্র। কয়েকটি পরীক্ষায় কোনো নম্বর দেয়নি এইচআর।

বাংলাদেশ ব্যাংকের পর্যবেক্ষক দল বলছে, এইচআর পলিসি ছিল শুধু খাতা-কলমে, যার কোনো প্রয়োগ ছিল না।

প্রধান অফিসের পাশাপাশি শাখা অফিসগুলোতেও নিজেদের লোক বসিয়ে সুপারিশের ঋণ অনুমোদন করাত এ চক্র।

গুলশান শাখায় কয়েকটি ঋণের ক্ষেত্রে দেখা যায়, কোনো ‘স্যাংশন লেটার’ ছাড়াই শুধু চেয়ারম্যানের সুপারিশে বড় বড় ঋণ অনুমোদন করা হয়েছে। ২০১৭ সালে গুলশান শাখাসহ বেশ কয়েকটি শাখা থেকে আলাদা আলাদা অ্যাকাউন্টে ৪০ কোটি, ১২ কোটি ৪৫ লাখ, ৯ কোটি ১৫ লাখ, ১০ কোটি ৭৭ লাখ টাকা প্রদান করা হলেও কোনোটির ক্ষেত্রেই ব্যবস্থাপনা কমিটি ‘লোন স্যাংশন’ করেনি।

একই বছরের অক্টোবর মাসের ১৮ তারিখে ৪০ কোটি টাকার ঋণ বর্ধিতকরণের জন্য চেয়ারম্যান ও এমডি ফরমাল সুপারিশ করলেও তার আগেই ঋণটি প্রদান করা হয়, যেখানে কোনো প্রকার ব্যাংকিং নিয়মের তোয়াক্কা করা হয়নি।

বাংলাদেশ ব্যাংকের রিপোর্টে আরও উঠে আসে, বড় ঋণগ্রহীতাদের মধ্যে বাবুল চিশতীর ভাই ও তার ছেলের কয়েকটি কোম্পানি ছিল, যেসব কোম্পানির নামে বিপুল অর্থ বের করে নেওয়া হয় ফারমার্স ব্যাংক থেকে। শুধু তা-ই নয়, ভুয়া ও সাইনবোর্ড-সর্বস্ব প্রতিষ্ঠানকে মোটা কমিশনের বিনিময়ে বড় অঙ্কের লোন দিতেও কার্পণ্য করত না এ চক্র।

ব্যাংকের শেয়ার দেওয়ার কথা বলেও কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগ রয়েছে এই দুজনের বিরুদ্ধে। আমানতকারীদের অর্থ লুট করার উদাহরণও তৈরি করেছিলেন তারা।

ঋণ কেলেঙ্কারির কারণে বাবুল চিশতী ও তার পরিবারের বিরুদ্ধে ১২টি মামলা করে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।

ব্যাংক খাতে যেন আর কখনোই এমন ঘটনার পুনরাবৃত্তি না হয়, সে জন্য তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করার দাবি তুলছেন খাত সংশ্লিষ্টরা।

  • Related Posts

    “লাল সবুজের জার্সিতে খেলতে দেশে আসছেন হামজা চৌধুরী।”

    সংবাদ বিভাগ: বর্তমানে বাংলাদেশে ক্রীড়াঙ্গনের সবচেয়ে আলোচিত একটি নাম হলো হামজা দেওয়ান চৌধুরী। কয়েকদিন পূর্বেই বাংলাদেশের জার্সিতে বাংলাদেশের হয়ে খেলবে বলে নিশ্চিত করেছেন ইংলিশ ফুটবলের এই ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডার। পরিশেষে অপেক্ষার…

    “আমাদের ওপর আক্রমণ করবেন না: আইজিপি”

    সংবাদ বিভাগ: পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) বাহারুল আলম বলেছেন, আমাদের কাজ করতে দেন। অনুগ্রহ করে আমাদের ওপর আক্রমণ করবেন না। বৃহস্পতিবার (১৩ মার্চ) সকাল ১০টায় গাজীপুরের ভোগড়া বাইপাস এলাকায় শিল্পপুলিশ-২ এর…

    Leave a Reply

    Your email address will not be published. Required fields are marked *