‘রেমিটেন্সি’ই দেশের অর্থনীতিকে চাঙ্গা করছে”

সংবাদ বিভাগ: অর্থনীতির যে ভঙ্গুর দশা হয়েছিল তার বিপরীতে প্রবাসীদের প্রেরিত রেমিট্যান্স হয়ে উঠেছে অর্থনীতি চাঙ্গা হওয়ার মাধ্যম। গত বছরের প্রথম ছ’মাসের চেয়ে শেষ ছ’মাসে রেমিট্যান্স বাবদ বেশি এসেছে ২৯৮ কোটি ডলার। বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন থেকে এ তথ্য জানা গেছে।

প্রাপ্ত তথ্যে জানা যায়, পরিস্থিতি এমন দাঁড়ায় যে, বেসরকারি ব্যাংকগুলো টাকাশূন্য হয়ে পড়ে। আওয়ামী লীগ সরকার বিতাড়িত হওয়ার পর আর্থিক খাতের শূন্যতা প্রকাশিত হতে শুরু করে। তবে শীঘ্রই পরিস্থিতির উন্নতি হতে থাকে এবং প্রধানত রেমিটেন্স প্রবাহ বৃদ্ধি অর্থনীতিতে প্রভাব রাখতে শুরু করে।

টাকা পাচারের মহোৎসব

বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে ২০০৯ থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে ২৩ হাজার ৪০০ কোটি ডলার বিদেশে পাচার হয়েছে বলে সর্বশেষ তথ্যে প্রকাশ। বর্তমান বাজারদরে এর পরিমাণ ২৮ লাখ কোটি টাকা। এই হিসাবে প্রতিবছর গড়ে ১ লাখ ৮০ হাজার কোটি টাকা পাচার হয়েছে। আওয়ামী লীগ সরকারের আমলের দুর্নীতিগ্রস্ত রাজনীতিবিদ, ব্যবসায়ী, আর্থিক খাতের রাঘববোয়াল, আমলা ও মধ্যস্বত্বভোগীরা এই পরিমাণ অর্থ পাচার করেছেন। এই বিপুল অর্থ পাচারের খাতগুলো ছিল ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে আর ফেরত না দেয়া (ঋণ খেলাপি), আর্থিক প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে সরাসরি টাকা লুট, বিদেশ থেকে পণ্য আমদানির জন্য এলসি করে পণ্য না এনে বিদেশেই টাকা রেখে দেয়া, শেয়ার বাজারে কারসাজি করে টাকা লুট, বেনামে ও ভুয়া একাউন্ট খুলে এবং ভুয়া কোম্পানি খুলে সেগুলোর নামে কথিত ঋণ নিয়ে টাকা মেরে দেয়া, সরকারি টেন্ডার ও কেনাকাটায় ব্যয় বিপুল পরিমাণে বৃদ্ধি দেখানো প্রভৃতি কৌশল ছিল অর্থ আয়, আদায় ও পাচারের মাধ্যম। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রিজার্ভ পাচার দিয়ে যাত্রা শুরু হয়ে রূপপুর বিদ্যুত কেন্দ্রের টাকা পাচার ছিল সর্বশেষ লুন্ঠনের ইতিবৃত্ত।

টাকাশূন্য ব্যাংক

পতিত আওয়ামী লীগ সরকার টাকা লুট করতে গিয়ে কিছু কিছু ব্যাংককে বলতে গেলে কপর্দকশূন্য করে ফেলে। এর জেরে অক্টোবর-নভেম্বর নাগাদ গ্রাহকের টাকা দিতে না পেরে হাহাকার পড়ে যায় অনন্ত ১১টি ব্যাংকে। প্রকাশিত তথ্যে জানা যায়, সেসময় বিশেষ করে বিতর্কিত ব্যবসায়ী এস. আলমের কবজায় যে ব্যাংকগুলো ছিল সেগুলো ছাড়াও অন্তত ১১টি ব্যাংকে নগদ টাকার সংকট বেশি দেখা দেয়। নিজের জমানো টাকা তুলতে গেলেও গ্রাহকদের এসব ব্যাংক থেকে খালি হাতে ফিরতে হয়। গ্রাহককে চাহিদা মাফিক টাকা দিতে ব্যর্থ হচ্ছিল এই ব্যাংকগুলো। গ্রাহকরা এক শাখা থেকে আরেক শাখায় দৌড়ে টাকা তুলতে চেষ্টা করেন। ক্ষুব্ধ হয়ে ঢাকাসহ দেশে বিভিন্ন জেলায় ওই ব্যাংকগুলোর কোনো কোনো ব্রাঞ্চে তালা ঝোলানোর ঘটনাও ঘটতে থাকে। আবার টাকা না পেয়ে ব্যাংক কর্মকর্তাদের সঙ্গে বাকবিত-ায়ও জড়ান গ্রাহকরা। ব্যাংকের পাশাপাশি এই সঙ্গে বিমা কোম্পানিগুলোর ক্ষেত্রেও এই অবস্থা আজো অব্যাহত আছে। বিমা কোম্পানিগুলো মেয়াদ পূরণের পর বছরের পর বছর অতিবাহিত হলেও বিমার টাকা পরিশোধ করতে ব্যর্থ হচ্ছে বলে সূত্রে প্রকাশ।

রেমিটেন্স প্রবাহ বৃদ্ধি

বিশ্লেষকরা মনে করেন, এভাবে দেশের আর্থিক ভিত দুর্বল করে ফেলা হয় গত আওয়ামী সরকারের আমলে। ফলে সেই সরকারের আকস্মিক পতনে আর্থিক পরিস্থিতি অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়ে। এমতাবস্থায় প্রবাসীদের পাঠানো রেমিটেন্স সেই অনিশ্চয়তাকে অনেকটাই রুখে দেয়। প্রাপ্ত তথ্যে জানা যায়, ২০২৪-২৫ অর্থবছরের জুলাই-ডিসেম্বর মাসে দেশে রেমিট্যান্স এসেছে ১ হাজার ৩৭৭ কোটি ৬০ লাখ ৮০ হাজার মার্কিন ডলার। যা গত অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় ২৯৭ কোটি ৬৪ লাখ মার্কিন ডলার বা ২৭.৫৬ শতাংশ বেশি। ২০২৩-২৪ অর্থবছরের জুলাই-ডিসেম্বর মাসে দেশে রেমিট্যান্স এসেছিল ১ হাজার ৭৯ কোটি ৯৬ লাখ ৮০ হাজার মার্কিন ডলার। ২০১৯-২০ অর্থবছরে দেশে রেমিট্যান্স এসেছিল ১৮ দশমিক ২০ বিলিয়ন ডলার। আর ২০২১-২২ অর্থবছরে ২১ দশমিক ০৩ বিলিয়ন এবং ২০২২-২৩ অর্থবছরে ২১ দশমিক ৬১ বিলিয়ন ডলারের রেমিট্যান্স দেশে আসে। গত ২০২৩-২৪ অর্থবছরে রেমিট্যান্স প্রবাহ কিছুটা বেড়ে ২৩ দশমিক ৯১ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত হয়। এবছর সেপ্টেম্বরে দেশে রেমিট্যান্স এসেছে ২ হাজার ৪০৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলার, যা গত বছরের একই মাসের তুলনায় ৮০ দশমিক ২০ শতাংশ বেশি। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, সেপ্টেম্বরে রেমিট্যান্সের এই প্রবাহ আগের মাসের তুলনায় ৮ দশমিক ১২ শতাংশ বেশি। চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত প্রবাসী বাংলাদেশিরা মোট ৬ হাজার ৫৪৩ মিলিয়ন মার্কিন ডলার রেমিট্যান্স পাঠিয়েছেন। গত অর্থবছরের একই সময়ে রেমিট্যান্স এসেছিল ৪ হাজার ৯০৭ মিলিয়ন মার্কিন ডলার।

ডিসেম্বরে রেকর্ড পরিমাণ ২.৬৪ বিলিয়ন ডলার রেমিট্যান্স এসেছে বলে বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যে জানা যায়। যা আগের বছরের একই মাসের তুলনায় প্রায় ৩২ শতাংশ বেশি। প্রবাসী বাংলাদেশি কর্মীরা ২০২৩ সালের ডিসেম্বরে দেশে প্রায় ২ বিলিয়ন ডলার রেমিট্যান্স পাঠিয়েছিল। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সর্বশেষ তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে জুলাই থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত রেমিট্যান্স প্রাপ্তিতে প্রবৃদ্ধি ২৭ দশমিক ৫৬ শতাংশে দাঁড়িয়েছে কারণ এই সময়কালে মোট ১৩ দশমিক ৭৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলার রেমিট্যান্স দেশে এসেছে। গত বছর যা ছিল ১০ দশমিক ৮০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার।

অর্থনীতিতে প্রভাব

রেমিট্যান্স প্রবাহ বৃদ্ধির ইতিবাচক প্রভাব পড়েছে দেশের অর্থনীতিতে। একজন কর্মকর্তা জানান, সরকার অনাবাসী বাংলাদেশিদের (এনআরবি) বৈধ চ্যানেলে দেশে অর্থ প্রেরণে উৎসাহিত করায় রেমিট্যান্সের প্রবাহ ঊর্ধ্বমুখী হয়েছে। রেমিট্যান্স প্রবাহ বৃদ্ধির ইতিবাচক প্রভাব পড়েছে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে। রিজার্ভের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ২৪ হাজার ৩শ’ মিলিয়ন ডলার। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) মানদ-ে যা ২০ হাজার মিলিয়ন ডলারের কাছাকাছি। বাংলাদেশ ব্যাংকের একজন কর্মকর্তা জানান, জুলাই থেকে আগস্টের মধ্যে রেমিট্যান্সের প্রবাহ বেড়েছে। প্রবাসীরা উল্লেখযোগ্য পরিমাণ রেমিট্যান্স পাঠাচ্ছেন, যা রিজার্ভ বৃদ্ধির বড় কারণ। সংকট কাটতে শুরু করায় ব্যাংকগুলো এখন নিজেদের ডলার কেনাবেচা করতে পারছে। এই সঙ্গে আন্তঃব্যাংক লেনদেন সক্রিয় থাকার কারণে বৈদেশিক মুদ্রার বাজার এখন স্থিতিশীল থাকবে বলেও জানান এই কর্মকর্তা।

তবে বিশ্লেষকরা মনে করেন, কেবল রেমিট্যান্সের উপর নির্ভরতা সামগ্রিক অর্থনীতিকে স্থিতিশীল রাখতে পারবে না। এজন্য রপ্তানি আয় বৃদ্ধি করতে হবে। বিদেশি বিনিয়োগ আসতে হবে। মানুষের কর্মসংস্থান নিশ্চিত করতে হবে। আশার কথা যে, ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রথমার্ধে বাংলাদেশের রপ্তানি আয় আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় প্রায় ১৩ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। গত বছরের আগস্ট ও সেপ্টেম্বর মাসে শ্রমিক অসন্তোষের কারণে উৎপাদন কিছুটা বিঘিœত হলেও তৈরি পোশাক খাতে স্থিতিশীলতা ফিরে আসায় এই প্রবৃদ্ধি সম্ভব হয়েছে।

  • Related Posts

    বাণিজ্য উপদেষ্টা’র সাথে সাক্ষাৎ করলেন পাকিস্তানের ব্যবসায়ী প্রতিনিধি দল

    সংবাদ বিভাগ: পাকিস্তানের ব্যবসায়ী প্রতিনিধিদল বাংলাদেশের বাণিজ্য উপদেষ্টার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন, পাকিস্তান ফেডারেশন অফ চেম্বারস অফ কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (এফপিসিসিআই) সভাপতি জনাব আতিফ ইকরাম শেখের নেতৃত্বে পাকিস্তানের একটি ব্যবসায়ী প্রতিনিধিদল…

    দাম বেড়েছে সবজির, মুরগির বাজার চড়া

    সপ্তাহ ব্যবধানে রাজধানীর বাজারগুলোতে সরবরাহ বাড়লেও দাম কমেনি সবজির। শুক্রবার (১৩ সেপ্টেম্বর) রাজধানীর ভাটারা নতুনবাজার, বাড্ডার বাজার ঘুরে দেখা গেছে এমন চিত্র। সরবরাহ কমে যাওয়ায় বাজারে সব ধরনের সবজির দাম…

    Leave a Reply

    Your email address will not be published. Required fields are marked *