“যত চ্যালেঞ্জের মুখে এনসিপি”

সংবাদ বিভাগ: আত্মপ্রকাশের দেড় মাসের মাথায় নানামুখী চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে জুলাই গণঅভ্যুত্থানে নেতৃত্বদানকারী ছাত্রদের রাজনৈতিক দল জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)। দল গঠনের পরপরই সব আসনের প্রার্থিতা দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে দলটি। এরই মধ্যে দলটির শীর্ষ নেতারা নিজ নিজ এলাকায় চালাচ্ছেন নির্বাচনি প্রচারণা।

তবে বিপদ দেখা দিয়েছে নির্বাচন কমিশনের গণবিজ্ঞপ্তি অনুযায়ী নির্ধারিত সময়ের মধ্যে নিবন্ধের আবেদন নিয়ে। নির্ধারিত ২০ এপ্রিলের মধ্যে আবেদন করার জন্য দলটির এখনো নেই যথেষ্ট প্রস্তুতি। এ ছাড়া দল গঠনের পর থেকে বিএনপিসহ অন্যান্য রাজনৈতিক দলের সঙ্গে বেড়েছে দূরত্ব। বিভিন্ন জয়গায় এ দুই দলের নেতারা সংঘর্ষে জড়াচ্ছেন।

আগামী সংসদ নির্বাচনের দিনক্ষণ, সংবিধান সংস্কারের দাবিতে গণভোট ইস্যুতে বিএনপিসহ অধিকাংশ রাজনৈতিক দলের সঙ্গে এনসিপির অবস্থান বিপরীতমুখী। এসব দাবিতে পাশে পাচ্ছে না শক্তিশালী কোনো দলকেও। এর আগেও শক্ত মিত্র না থাকায় রাষ্ট্রপতির অপসারণ, সংবিধান বাতিল, রাষ্ট্র সংস্কার, আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধসহ নানা দাবি পূরণ করতে পারেনি দলটি।

তবে এনসিপির শীর্ষ নেতারা বলছেন, নিবন্ধনের শর্ত পূরণ করা আমাদের জন্য খুব একটা কঠিন বিষয় নয়। বাকি যে চ্যালেঞ্জগুলো আছে, তা মোকাবিলা করেই আমরা কেন্দ্র থেকে তৃণমূল পর্যন্ত দলকে শক্তিশালী করার জন্য জোর দিচ্ছি। আশা করছি তারুণ্যের শক্তি হারবে না। নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্তের আকাক্সক্ষা নিয়ে গত ২৮ ফেব্রুয়ারি আত্মপ্রকাশ করে তারুণ্য শক্তির নতুন রাজনৈতিক দল এনসিপি। দুই দফায় ২১৬ সদস্যবিশিষ্ট আংশিক কমিটি ঘোষণা করেছে।
বিএনপিসহ অন্যান্য দলের সঙ্গে বেড়েছে দূরত্ব: এদিকে দল গঠনের পর নানা বিষয় নিয়ে দূরত্ব তৈরি হয়েছে বেশ কয়েকটি রাজনৈতিক দলের সঙ্গে। গণঅধিকার পরিষদসহ বিভিন্ন দলের নেতারাও এনসিপির বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ সামনে আনছেন। বিভিন্ন জায়গায় বিএনপির সঙ্গে সংঘর্ষেও জড়িয়েছেন এনসিপি ছাড়াও জুলাই গণঅভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দেওয়া ছাত্রদের সংগঠন জাতীয় নাগরিক পার্টি ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতারাও।

জুলাই গণঅভ্যুত্থানের প্রভাবশালী নেতা বর্তমানে জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) সিনিয়র যুগ্ম মুখ্য সমন্বয়ক আবদুল হান্নান মাসউদ সম্প্রতি তার নির্বাচনি এলাকা হাতিয়ায় গণসংযোগ করতে গিয়ে বিএনপির নেতাকর্মীদের হামলার শিকার হয়েছেন। এ ছাড়া মিরপুর, চট্টগ্রামসহ বিভিন্ন জায়গায় দল দুটির নেতাকর্মীদের মধ্যে হামলা ও পালটা হামলা হয়েছে।

নির্বাচন ইস্যুতেও রাজপথের প্রভাবশালী দল বিএনপির সঙ্গে এনসিপির অবস্থান সম্পূর্ণ বিপরীতমুখী। বিএনপি এই ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচনের দাবিতে অনড় থাকলেও এনসিপি বলছে, আগে সংস্কার তারপর নির্বাচন। শুধু তাই নয়, রাষ্ট্রপতির অপসারণ, সংবিধান বাতিল, রাষ্ট্র সংস্কার, আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ, একাত্তর ও চব্বিশের মধ্যে সম্পর্ক, সেকেন্ড রিপাবলিক ইস্যুতেও বিএনপিসহ কয়েকটি রাজনৈতিক দলের সঙ্গে এনসিপির অবস্থান ছিল বিপরীতমুখী। ফলে কোনো দাবিই পূরণ করতে পারেনি দলটি।

সর্বশেষ গতকাল জাতীয় সংসদের এলডি হলে ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) বৈঠকে দলটির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম বলেছেন, রাষ্ট্রকাঠামোর মৌলিক সংস্কার চান তারা। কোনো দলকে ক্ষমতায় বসানোর ইচ্ছা নেই। তিনি আরও বলেন, ফ্যাসিবাদী ব্যবস্থা বিলুপ্ত করে এনসিপি নতুন বন্দোবস্ত চায়। কোনো গোষ্ঠী ও দলের স্বার্থে যদি সংস্কার আটকে যায়, তাহলে জনগণ আবার রাস্তায় নামবে বলেও জানিয়েছেন তিনি।

এ ছাড়া প্রশাসন অনেক জায়গায় বিএনপির পক্ষে কাজ করছে। এ ধরনের প্রশাসনের অধীনে নির্বাচন করা সম্ভব নয় বলেও এরই মধ্যে জানিয়েছেন দলটির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম। গত বুধবার বিকেলে ঢাকা সফররত যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়াবিষয়ক উপসহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী নিকোল চুলিকের সঙ্গে বৈঠক শেষে তিনি আরও বলেছেন, ‘আমরা এখানে রাষ্ট্রের মৌলিক সংস্কার, গুণগত পরিবর্তনের জন্য কাজ করছি। কোনো ধরনের মৌলিক পরিবর্তন ছাড়া নির্বাচনের দিকে গেলে সেই নির্বাচন গ্রহণযোগ্য হবে না এবং সেই নির্বাচনে জাতীয় নাগরিক পার্টি অংশগ্রহণ করবে কি না, তা বিবেচনাধীন থাকবে।
তার এমন মন্তব্য ঘিরে রাজনৈতিক অঙ্গনে নতুন করে আলোচনা শুরু হয়েছে। তার এই বক্তব্য দলটির দীর্ঘদিনের অবস্থানেরই প্রতিফলন বলে মনে করেছেন এনসিপির শীর্ষ নেতারা। বিষয়টি নিয়ে এনসিপির সিনিয়র যুগ্ম আহ্বায়ক আরিফুল ইসলাম আদীব গণমাধ্যমকে বলেন, পরবর্তীতে ক্ষমতায় কে আসবে, বাংলাদেশের আমলাতন্ত্র সে অনুযায়ী কাজ করে। এরা (আমলারা) সব সময় একটি আশ্রয়ে থাকতে চায়। আওয়ামী লীগ আমলাদের এতদিন ধরে আশ্রয় দিয়েছে। তাই আমলারা আওয়ামী লীগের জন্য কাজ করে গেছে। বড় দল হিসেবে পরবর্তীতে বিএনপিরই ক্ষমতায় আসার সম্ভাবনা আছে। তাই প্রশাসন দেখল যে সরকার দ্রুত নির্বাচন দিলে ক্ষমতায় আসবে বিএনপি। সে কারণে বিএনপির সঙ্গে তারা একধরনের দরকষাকষিতে আছে। প্রশাসন মানে রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠানগুলো। তাদের বিএনপির প্রতি নমনীয় আচরণ শুরু হয়েছে।

সংবিধান সংস্কারে গণভোট ইস্যুতে পাশে নেই কেউ : এ ছাড়া সংবিধান সংশোধনের জন্য গণভোটের দাবি করছে এনসিপি। দলটির আত্মপ্রকাশ অনুষ্ঠানেও এ দাবি তোলা হয়েছিল। কিন্তু এই গণভোটের পক্ষে নয় বিএনপিসহ অধিকাংশ রাজনৈতিক দলই। এ ছাড়া খেলাফত মজলিস, ইসলামী আন্দোলন, হেফাজতে ইসলাম, নাগরিক ঐক্য, গণঅধিকার পরিষদ, সিপিবি-বাসদসহ অন্যান্য বাম দল এবং বিএনপির মিত্র দলগুলোও চলতি বছরের মধ্যে ভোট চায়। সব মিলিয়ে সংস্কারের পরে ভোট এবং সংবিধান সংস্কারের জন্য গণভোটের বিষয়ে খুব একটা শক্তিশালী দলকে পাশে পাচ্ছে না এনসিপি। অনেক দলই এই ইস্যু চেপে যাচ্ছে। দুই-একটি দল গণভোটের কথা বলেও সেই দাবি আদায়ে খুব সক্রিয় নয়।

নানা বিতর্কও: শতাধিক গাড়ির বহর নিয়ে নিজ এলাকা পঞ্চগড়ের আটোয়ারীতে গিয়ে দলের ভেতরেই প্রশ্নের মুখে পড়েছেন এনসিপির মুখ্য সংগঠন (উত্তরাঞ্চল) সারজিস আলম। ব্যয়বহুল এসব ব্যক্তিগত কর্মসূচির অর্থের উৎস নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। এ ছাড়া সর্বশেষ এনসিপির পহেলা বৈশাখ অনুষ্ঠানে উপস্থিতি কম হওয়ায় বিতর্কের মুখে পড়ে দলটি। অনেকেই এর সমালোচনা করেন। তবে এই সমালোচনার জবাব দিয়েছেন দলটির সিনিয়র যুগ্ম আহ্বায়ক সামান্তা শারমিন।

তিনি বলেন, ‘আমাদের শুধু একটি সেন্ট্রাল কমিটি রয়েছে, যেখানে ২১৭ জন সদস্য কাজ করছেন। এই ২১৭ জনের কাঁধেই পুরো দেশের সাংগঠনিক দায়িত্ব। অনেকেই বর্তমানে জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে কাজ করছেন, ফলে ঢাকায় উপস্থিতির সংখ্যা স্বাভাবিকভাবেই কিছুটা কম ছিল। অন্যদিকে আত্মপ্রকাশের পরপরই দলটি থেকে পদত্যাগ করেন যুগ্ম মুখ্য সমন্বয়ক আবু হানিফ, যুগ্ম মুখ্য সংগঠক (উত্তরাঞ্চল) হানিফ খান সজীব ও যুগ্ম মুখ্য সমন্বয়ক আব্দুজ জাহের। সর্বশেষ গতকাল শনিবারও দলটি থেকে পদত্যাগ করেছেন যুগ্ম মুখ্য সমন্বয়ক রাফিদ এম ভূঁইয়া। এসব নিয়েও দলটি পড়েছে বিতর্কের মুখে।

নিবন্ধন ও দল গোছাতে তোড়জোড়: নিবন্ধন আবেদনের দিনক্ষণ ঘনিয়ে আসার আগেই দল গোছাতে মনোযোগ দিচ্ছে এনসিপি। বিশেষ করে কেন্দ্রের পাশাপাশি তৃণমূলকে আরও শক্তিশালী করতে চায় দলটি। এরই মধ্যে শীর্ষ নেতারা বিভিন্ন জেলা-উপজেলায় দল গোছানোর জন্য সাংগঠনিক সফর করছেন। সর্বশেষ গত শুক্রবার এনসিপির অস্থায়ী কার্যালয়ে দলটির তৃতীয় সাধারণ সভা অনুষ্ঠিত হয়। দলটির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলামের সভাপতিত্বে ওই সভায় সাংগঠনিক গতিশীলতা বাড়ানোর লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় নীতিমালা প্রস্তাব করেন মুখ্য সংগঠক (উত্তরাঞ্চল) সারজিস আলম ও মুখ্য সংগঠক (দক্ষিণাঞ্চল) হাসনাত আব্দুল্লাহ।

  • Related Posts

    “ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে আবারও বৈঠকে বসেছে বিএনপি”

    সংবাদ বিভাগ: জাতীয ঐকমত্য কমিশনের ভাইস চেয়ারম্যান সংবিধান সংস্কার কমিশনের প্রধান অধ্যাপক আলী রীয়াজের সভাপতিত্বে বৈঠকে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহ উদ্দিন আহমেদের নেতৃত্বে ৪ সদস্যের প্রতিনিধি দল অংশ নিয়েছেন।…

    “১৬টি গরু থানায় আটকে ঘুষ দাবি: ওসি স্ট্যান্ড রিলিজ”

    সংবাদ বিভাগ: ঠাকুরগাঁও সদর থানার ওসি শহিদুর রহমানকে স্ট্যান্ড রিলিজ করা হয়েছে। সদর থানায় যোগদানের ৫ মাসের মাথায় স্ট্যান্ড রিলিজ হলেন তিনি। সম্প্রতি, জেলা শহরের সরকারপাড়ার বাসিন্দা কয়েকজনের ১৬টি গরু…

    Leave a Reply

    Your email address will not be published. Required fields are marked *